Thursday, April 23, 2020

অসুখ

রমেনের সাথে আমার দেখা অনেকদিন পর হঠাৎ করেই | কলকাতা গিয়েছিলাম একটা কাজে , ভাবলাম একবার কলেজে ঢুঁ মেরে যায় | ফেরার পথে একটু রবীন্দ্রসদন চত্ত্বরে একটু ঘুরে পিজি বাস স্টপটার সামনে এসে দাঁড়ালাম, ক্যাব ধরতে পারতাম কিন্তু ভাবলাম এখানে দাঁড়িয়ে আরেকটু স্মৃতি রোমন্থন করি | এমন সময় হঠাৎ একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো| কাঁচ নামাতেই দেখি রমেন | আমি অবাক | সেই প্রাইমারি থেকে একসাথে পড়লেও পরে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং এ গেলাম আর রমেন ডাক্তারি তে | এরপর একটু আধটু যোগাযোগ থাকলেও সেটা ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছিল, বিশেষত রমেন ফেসবুকে নেই , তাই যোগাযোগটা একেবারেই ছিন্ন হয়ে গেছিল | আজকে হঠাৎ এখানে দেখা |

- তুই এখানে ? হাতে সময় থাকলে উঠে আয় |

আমি এমনিই  ঘুরছিলাম স্মৃতির তাড়নাতে, উঠে পড়লাম, রমেন পিজিতে এসেছিল একটা সেমিনারে , গাড়ি চড়ে আমরা এমনিই  খানিক ঘুরে স্মৃতিচারণ করতে লাগলাম | কত কথা |

- আমি ফেসবুকে না থাকলেও হোয়াটস্যাপে আছি |

নম্বরটা সেভ করে নিলাম , কথায় কথায় প্রাইমারি স্কুলের হোয়াটস্যাপ গ্রূপ  খোলার কথা উঠলো, দুজনেই ঠিক করলাম এটা করতেই হবে, অনেকের সাথেই যোগাযোগ নেই, সেই ক্লাস ৪ এর পর থেকেই |

ইতস্তত ঘুরছি গাড়িতে, ময়দানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ গাড়িটা আস্তে করে দাঁড় করলো রমেন |

আমি জিজ্ঞেস করলাম - কি হলো ?

রমেন কাঁচ নামিয়ে আমাকে দেখালো , এক ভদ্রমহিলা, বেশভূষা দেখে মনে হয় নিম্ন মধ্যবিত্ত , বোধহয় ত্রিশের কোঠায় , আরেকটু বেশি এ বয়স্ক লাগছিল, একটা বছর দশেকের ছেলের সাথে শিশুর মতো খেলছে |

- কি দেখলি ?

আমি বললাম যা দেখলাম |

রমেন একটু ক্ষণ চুপ থেকে বললো - চল একটু বসি |

মাঠে দুজনে বসলাম  | সামনে একটা চা-ওয়ালা ঘুরছিলো , দুজনে দুটো চা নিলাম |  সিগেরেট ধরালাম একটা |

-আজ হঠাৎ বছর কয়েক আগের একটা কথা মনে পড়ল|

রমেন বলে চলল|

- সেদিন বাড়িতে সকালটা একটু গোলমেলে ছিল , মানে সাংসারিক গোলমাল আর কি ! চেম্বার এ পৌঁছতে দেরি হয়ে গেছে , মেজাজটাও খিঁচড়ে আছে, গিয়ে দেখি পেশেন্টদের লম্বা লাইন | সেই লাইনে খুব চেনা একজনকে চোখে পড়ল , আর মেজাজটা আরো বিগড়ে গেল | মৌসুমী মন্ডল ,আমার পুরোনো পেশেন্ট|

- আবার চেম্বার এ ঢুকে শুরু করবে বুকে ব্যাথা , হাতে ব্যাথা, পেটে ব্যাথা |

প্রথমবার বরের সাথে এসেছিল তারপর থেকে একাই আসে ছেলেকে নিয়ে | যত রকম টেস্ট করা সম্ভব করেছি |

-সরকারি হাসপাতাল অতিরিক্ত টেস্ট আমরা করাই না | তবু X -Ray, ইসিজি, Echo , স্ক্যান , সব করিয়েছি , কোথাও কিছু নেই | আমি তিতিবিরক্ত একই ঘ্যানঘ্যান বারবার শুনে শুনে | আবার নাটক শুরু হবে মনে মনে বললাম | সব মানসিক রোগী |

আমার কম্পউণ্ডার বলরাম কে ডেকে বললাম - "মৌসুমী মন্ডল কত নম্বর এ ?"

বলরাম বলল - ২ নম্বর , সেই ভোর থেকে এসে বসে আছে |

- বসে থাকুক, অন্যদের পাঠাও , যতক্ষণ না বিরক্ত হয়ে সে চলে যাচ্ছে | ওকে দেখার কোনো ইচ্ছে নেই  আমার |

সেদিন চেম্বার এ দারুন সব পেশেন্ট , জেনুইন পেশেন্ট আর কি ! দেখছি , অনেকগুলো অব্যর্থ ডায়াগনসিস করেছি তা বুঝলাম বিভিন্ন টেস্ট এর ফল দেখে | ভাবছি এই জন্যই তো ডাক্তারি পড়া , নাকি ওই মানসিক রোগীদের চিকিৎসা করার জন্য |

দেখতে দেখতে মৌসুমীর কথা বেমালুম ভুলে গেছি | দেখতে দেখতে দুপুরের খাওয়ার টাইম হয়ে গেল |

বলরাম ও আর মৌসুমীর কথা বলেনি|

লাঞ্চব্রেক সেরে আবার চেম্বার এ ফিরলাম, কয়েকজন সকালে বলা টেস্ট করে এনেছে রিপোর্ট দেখাতে, তাদের দেখা শেষ করে একটু রাউন্ড এ যাবো  ভাবছি এমন সময় বলরাম ঢুকলো |

-স্যার , মৌসুমী এখনও বসে |

ততক্ষনে মৌসুমী ও দরজাতে এসে বলল -  ডাক্তারবাবু আমি তো ২ নম্বরে ছিলাম, আপনি দেখলেন না ?

তার মুখে একটা ক্ষীণ হাসি |

আমি হাত জোর করে বললাম - মৌসুমী তোমার চিকিৎসা করা আমার সাধ্যি নয় ! তোমার কোনো রোগ নেই, তুমি বরং এক মানসিক রোগের ডাক্তার দেখাও |

তার ক্ষীণ হাসিটা আরেকটু প্রশস্ত হলো |

-আমিও জানি আমার কোনো রোগ নেই |

এবার আমার চমকের পালা | একটু রেগে বললাম

-তাহলে এসবের মানে কি ?

সে অন্যদিনের মতো আজ কুঁকড়ে নেই , বরং অনেক বেশি বেপরোয়া , ছেলেকে বাইরে বসতে বসে সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো  - ভেতরে একটু আসতে পারি ?

আমার তখনও চমক ভাঙেনি, আমি আসতে বললাম |

-বুকের উপর প্রতি রাতে হাতুড়ি পেটানোর চিকিৎসা কোন ডাক্তার করবে আপনি বলতে পারেন ডাক্তারবাবু? প্রতি রাতে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্বামী যে অত্যাচার করে ! তার চিকিৎসা কি মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে আছে? বিয়ের পর থেকে প্রতি রাতে যে নির্যাতন স্বামী করে, আর বাধা দিলেই চলে অকথ্য গালাগাল ও মার | বাচ্চাদের সামনে ইয়ার বন্ধুদের ঘরে ঢোকায় , জুয়া খেলে আমাকে তুলে দেয় তাদের হাতে , সেই অত্যাচারের দাগ সারা শরীরে এ দগদগে ঘায়ের মতো তা আমি কাকে দেখাবো বলুন ? সমাজও তো তার পক্ষে , এর চিকিৎসা কোন ডাক্তার করবে বলুন? আপনার দোষ নেই | আপনার সময় নষ্ট করেছি বলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী|

সে চুপ করলে আমি খানিক থেমে জিজ্ঞেস করলাম - তাহলে আমার কাছে আসো কেন বারবার ?

-আমি জানি আমার বুকের ব্যামো নেই, কিন্তু আপনাকে দেখানোর জন্য আমার মাসে দুবার এখানে আসার সুযোগ মেলে , আপনি পরীক্ষা করাতে দেন, তার কাগজ আপনাকে দেখাতে আসি , এগুলোর দৌলতে আমি সুযোগ পাই দুদিন ছেলেকে নিয়ে শহর ঘোরার | আমার জীবন আমি বাঁচি ওই দুদিন | ডাক্তার দেখানোর অজুহাতে ওই দুদিন স্বাধীনতাটুকু উপভোগ করি | দয়া করে আমাকে এটুকু থেকে বঞ্চিত করবেন না |

এক অপরাধববোধে আমার শরীর কাঁপছে | কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম - তাহলে  এতক্ষন অপেক্ষা করার কি দরকার ? এমনি চলে গেলেই হলো ?

-আপনার প্রেসক্রিপশন দেখতে চায়যে আমার মরদ | সেটা না পেলে আসা বন্ধ তো হবেই , সাথে জুটবে আরো মার, আরো অত্যাচার | আমি শুধু শারীরিক ভাবে নয়, মানসিক ভাবেও ধর্ষিত হই রোজ, এটুকু থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না |

তার চোখের কোনাতে এতক্ষন জলের আবছা ছায়া ছিল, এখন টা বাঁধ ভাঙলো | হাতের মধ্যে মুখ গুঁজে সে ভেঙে পড়ল কান্নায় |

আমি আর পারলাম না | বলরাম কে ডেকে বললাম

-এরপর থেকে মৌসুমী এলে সবার আগে আমার কাছে ওকেই পাঠাবে |

খসখস করে প্রেসক্রিপশনে অনেক কিছু লিখে ফেললাম,আরো কিছু সাধারণ রক্ত পরীক্ষা সহ |

তার মুখে হাসি ফুটলো |

এই পর্যন্ত বলে রমেন থামলো |

আমার চোখটা গেল সেই মা ও তার ছেলের দিকে | সত্যি স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও কজনের কাছে পৌঁছেছে তা | কত মৌসুমী যে শহরের বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমরা কি তার খবর রাখি | পর্যন্ত সূর্যের আলোতে মা ও ছেলের বেলুন নিয়ে খেলা হঠাৎ করে বিকেলটাকে আরো উজ্জ্বল করে দিলো | এই আলো কবে আমাদের মনের অন্ধকার দূর করবে কে জানে !

© অরিন্দম রায়

#সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত।

No comments:

Post a Comment