Wednesday, October 28, 2020

কানুকার কেরামতি

বাড়িতে ছুটিতে বসে আছি, পুরোনো বই এর তাক পরিষ্কার করতে গিয়ে বেরিয়ে এল পুরোনো এক অ্যালবাম , সাদা-কালো ছবিতে ঠাসা | সেটার মধ্যেই এই ছবিটা খুঁজে পেলাম, ছবিটা পুরোনো ফ্যামিলি পোর্ট্রেট , তবে ফ্যামিলি বলতে তখন শুধু বাবা-মা-দাদা-কাকা ছিল না , পাড়াতুতো কাকা-মাসি-পিসি রাও এর অংশ ছিল | আর এই ছবির পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রিয় কানুকা , করুণা চরণ বিশ্বাস, ডাকনাম কানু , আমরা কানুকাকা না বলে কানুকা বলতাম | কানুকার কথা মনে পড়াতে অজান্তেই ঠোঁটের কোণে একটা হাসি এসে গেল , মানুষটাই তো সেরকম |

কানুকা ছিল আমাদের পাড়ার ক্লাব আমড়াতলা স্পোর্টিং এর প্রাণ | ক্রিকেট, ফুটবল যেকোনো ম্যাচ হলে সবার আগে তার ডাক পড়ত | না মানে সে যে ভালো খেলোয়াড় ছিল তা নয় , টুর্নামেন্ট কেন ফ্রেন্ডলি ম্যাচ এর টীম ও সে সুযোগ পেতনা | যদিও নিয়ম করে প্র্যাক্টিসে রোজ আসত | সুযোগ পেতনা বলে তার অভিযোগ ও ছিল না , তবু ক্লাবের খেলা থাকলে তার চাহিদা সবচেয়ে বেশি, সে হল পয়লা নম্বর সমর্থক ক্লাবের, শুধু চিৎকার করেই যে কত ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই | সেবারে গোল্ড কাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট এর ফাইনালের আগে পাটকাবাড়ি আমরাকজন দলের খেলোয়াড়রা আমাদের সেরা বোলার নিতাইয়ের আউটসুইং এর চেয়েও কানুকার চিৎকার নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিল| এমনকি তার আগের বছরের ফুটবল শিল্ড ফাইনালে আমাদের প্রতিপক্ষ কুমারপাড়া আমাদের সেন্টার ফরওয়ার্ড হরির চেয়ে কানুকাকে নিয়েই বেশির ভাগ সময় আলোচনা করেছিল ওদের টিম মিটিংয়ে | 

সেসব কথা থাক, আসল গল্পে আসি, এহেন কানুকা ও চুপ মেরে গেল সেদিন খেলার শুরুতে, তাও আবার শিল্ড ফাইনাল | ওহ মাঝখান থেকে শুরু করলাম বলে আপনারা ঠিক ধরতে পারছেনা না ! ঠিক আছে গোড়া থেকেই গল্পটা বলি | 


তারক ব্রহ্ম ভট্টাচার্য আমাদের গ্রামের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন | আগের মতো জমিদারী না থাকলেও সবাই তাকে শ্রদ্ধা করত, পাটের ব্যবসাতে পয়সা ও করেছিলেন খুব | তবে মানুষটাও ছিলেন উদার মনের , সবার দরকারে এগিয়ে আসতেন, সাহায্য করতেন | আমাদের আমড়াতলা স্পোর্টিং ক্লাব এর প্রধান পৃষ্ঠপোষকও তিনি , ব্যাট লাগলে ব্যাট , বল লাগলে বল, জার্সি , বুট সব কিছুরই যোগানদার তিনি | সেই তারক বাবুর ছেলের বিয়ের বৌভাত ছিল সেদিন | পরের দিন শিল্ড ফাইনাল | তাই আমাদের কোচ পুলক স্যার সব খেলোয়াড় কে বলেছেন একটু সামলে খেতে , কিন্তু আমাদের সেন্টার ব্যাক জগাই চিরকালই পেটুক | সেদিন প্রতিযোগিতা করে ৫৭ পিস খাশির মাংস আর ৬১ খানা রসগোল্লা খেয়েছে | ওর সাথে পাল্লা দিচ্ছিলো আরও কয়েকজন , কিন্তু তাদের গোহারা হারিয়ে দিয়েছে জগাই | কিন্তু তার ফল পেল হাতেনাতে | সারা রাত্তিরটা তাকে বাথরুমেই কাটাতে হল | সকালে নীলু ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে তার বহির্গমনের পথে কিঞ্চিৎ বাধা পড়ল | সে উঠে বসতে পুলক স্যার নীলু ডাক্তারকে কে জিজ্ঞেস করলেন -

- " বিকেলের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবে তো ! খেলা আছে ?"

ডাক্তারবাবু কড়া দৃষ্টিতে তাকালেন পুলক স্যার এর দিকে :

- " আপনারা এখন খেলার কথা বলছেন কি করে ? ছেলেটাকে মারবেন নাকি ? ও ২ মিনিট হাঁটলেই মাথা ঘুরে পরে যাবে ! আজ খালি বাৰ্লি খেয়ে শুয়ে থাকুক , কাল থেকে পাতলা করে ঝোল ভাত খেতে পারে , ৩ দিন সম্পূর্ণ বিশ্রাম |"

সুতরাং জগাই দলের বাইরে |

 শুধু জগাই একা হলে একটা কথা ছিল, ওর সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে আরও জানা চারেক আজ কাহিল , তারা উঠে বসতে পারলেও দৌড়োতে পারবে বলে মনে হচ্ছেনা | মরার উপর খাড়ার ঘা পড়ল যখন তারকবাবুকে স্টেশন মাস্টার জানালো যে একটা মালগাড়ি বেলাইন হয়ে পড়াতে আজকের আপ ট্রেন আসতে দেরি হবে | আমাদের জানা তিনেক খেলোয়াড় কলকাতার কলেজে পড়ে , তারা সকালের এই ট্রেনে ফিরবে বলেছিল , কিন্তু তারাও এবার অনিশ্চিত | এদিকে খেলার সময় ক্রমশ এগিয়ে আসছে | বারবার স্টেশনে লোক পাঠাচ্ছেন তারক বাবু আর অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন | তার বাবার নামে এই শিল্ড তিনিই চালু করেছেন , আর এ যাবৎ সব বারই জিতেছে আমাদের ক্লাব | শেষবার লোকজন এসে জানালো যে ট্রেন এর আশা না করা ই ভালো, অন্তত ৩ ঘন্টা লাগবে আরও | সুতরাং তিনি পুলক স্যার কে ডেকে পাঠালেন |

-" পুলক প্ল্যান বি নিয়ে ভাবতে হবে এবার !"

আলোচনা তে বসলেন তারকবাবু আর পুলক স্যার | পুলক স্যার আমাদের আমড়াতলা কেদার ব্রহ্ম স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়ের খেলার টিচার | আমড়াতলা স্পোর্টিং এর কোচ ও | এককালে জেলা দলের হয়ে ফুটবল খেলেছেন , তাই সবাই উনাকে খুব শ্রদ্ধা ও করে | 

দুজনে মিলে অনেক হিসেবে করে দেখলেন গত ম্যাচের ১৮ জনের মধ্যে ১০ জন পুরো ফিট আছে , ৮ জন হয় অসুস্থ নয় অনুপস্থিত | এদের মধ্যে প্রথম এগারোতে নিয়মিত শুধুমাত্র জগাই | সুতরাং তার একজন উপযুক্ত বদলি খেলোয়াড় চাই | দশ জন নিয়মিত খেলোয়াড় কে বলা হল যে তাদের পুরো ম্যাচ টাই খেলতে হবে যেভাবেই হোক, প্রয়োজন হলে চোট পেলেও | এগারো নম্বর খেলোয়াড় কে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা হবে |


 তারকবাবুর উড়ে মালি জীবনরাম কে নামানো হল শুরুতে জগাই এর জায়গাতে সেন্টার ব্যাকে | এতো লোক থাকতে মালি কেন সে প্রশ্ন আপনাদের মনে জাগতে পারে কিন্তু গ্রামে কারো মনে জাগেনি , কারণ গ্রামে খুব কম ছেলে ছোকরা আছে যারা জীবনরামের তাড়া খায়নি | যেই আম পাড়তে যায় তাকে লাঠি হাতে এমন তাড়া করে যে সবাই প্রাণ নিয়ে দৌড় লাগায় , ৫০ গজ পেছন থেকে এসেও ধরে ফেলতে পারে | একবার তো জেলার ১০০ মিটার চ্যাম্পিয়ন নবীন কেও পেছন থেকে তাড়া করে ধরে ফেলেছিল যখন সে আম চুরি করে পালাচ্ছিল | তাই এই সিদ্ধান্তে আমরা খুশিই হলাম | 


এবার খোঁজ হতে লাগলো এমন আরও সাত জন যারা ফুটবলে লাঠি মারতে পারবে অন্তত, বা দৌড়াদৌড়ি করতে পারবে | সবার আগে এলো কানুকার নাম , সে প্র্যাক্টিসে নিয়মিত , দৌড়াদৌড়ি ও করতে পারে, উৎসাহী ও | সুতরাং তারক বাবু তাকে ডেকে বললেন 

-"কানু জার্সি পড়ে রেডি হয়ে নাও, আজ তোমাকে মাঠে দরকার হতে পারে |"

এতক্ষন কানুকা দর্শকদের মধ্যে বসে চিৎকার করার আগে গরম জল দিয়ে গাগল করছিলো, সকল থেকে সে গলা সেধেছে , পকেটে যষ্টিমধু নিয়ে একেবারে প্রস্তুত , এমন সময় তারক বাবুর কথা শুনে কানুকা পুরো হাঁ হয়ে গেল , তাকে সবাই বোঝালো রিজার্ভ বেঞ্চ থেকেও চিৎকার করা যায় , আর তাছাড়া বেঞ্চে বসলেই খেলতে হবে এমন মাথার দিব্যি কেও দেয়নি | জীবনরাম খেলে দেবে চিন্তা নেই |

যথাসময়ে মাঠে দল নামল , বেশ ভালোই চলছিল শুরুর দিকে , কানুকা জার্সি পড়ে বসেই চিৎকার করছে , জীবনরাম ও খুব উজ্জীবিত , সে তার তাড়া শুরু করে দিয়েছে , বিপক্ষের কেউ বল ধরলেই এমন ভাবে তার দিকে তেড়ে যাচ্ছে যে তারা বল ছেড়ে পালাচ্ছে | কুমোর পাড়ার ভজা মিত্তির দারুন চৌখস খেলোয়াড় , তাকে জীবন এমন তাড়া লাগলো যে সে উল্টে দৌড় লাগলো নিজের গোল এর দিকেই , প্রচন্ড গতিতে , তার পেছনে ছুটল জীবন , চোখে মুখে তার আগুন | ভজা ও ছুটছে , পেছনে ছুটছে জীবনও , মাঠে উপস্থিত বাকি কুড়ি জন হাঁ করে দেখতে লাগল , শেষমেশ ভজা বল নিয়ে গোল লাইন পেরিয়ে দর্শকদের মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে রক্ষা পেল, আর আমড়াতলা পেল কর্নার |


কর্নার পেয়েছে দেখেই অত্যুৎসাহী জীবনরাম ছুট লাগালো কুমোরপাড়ার বক্সের দিকে , পুলক স্যার চিৎকার করে ডাকতে লাগলে, জীবনরাম নেমে আয় , নেমে আয় | কিন্তু কে কার কথা শোনে, আমাদের ক্যাপ্টেন রবি ওদিকে বল ভাসিয়ে দিয়েছে বক্সে আর জীবনরাম প্রায় উড়ে উড়ে পৌঁছে গেছে বক্সে , বল লক্ষ্য করে হরি হেড করবে বলে ঠিক সময়ে লাফিয়ে উঠেছে , আর তাকে বাধা দিতে কুমোরপাড়ার লেফট ব্যাক নবু, কিন্তু দুজনের কেউই বল ছুঁতে পারলো না, ওদের মাঝে এসে বুনো হাতির মতো দুজনকে ছিটকে দিয়ে জীবনরাম ততক্ষনে গোলপোস্টের কাছে পৌঁছে গেছে, নিজের গতি রোধ করতে পারল না সে, সোজা গিয়ে ধাক্কা মারল গোলপোস্টে , গোলপোস্ট কোনোক্রমে রক্ষা পেলেও জীবনরাম পেল না, একেবারে অজ্ঞান , স্ট্রেচারে করে তাকে মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হল, আমাদের মাথায় হাত, পুলক স্যারেরও | নিজেকে সামলে তিনি বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে বললেন ,

- "কানু তৈরি হও|"

######

এতক্ষন অবধি কানুকা খুব চিৎকার করছিলো কিন্তু পুলক স্যারের মুখে এই কথা শুনে কানুকা কেমন ঘাবড়ে গেল, এক্কেবারে চুপ মেরে গেল , চুপ করে বসেই আছে, সবাই ডাকলো "কানু ! এই কানু !" কিন্তু নো নড়ন চরণ | দুবার ঝাঁকুনি দিতে তার সম্বিৎ ফিরলো বটে , কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটেছে যেন , কোনো কথা নেই, এ কোন কানুকা ? গুটি গুটি পায়ে মাঠে নামলো, সেন্টার ব্যাকের জায়গাতে গিয়ে দাঁড়ালোও, কিন্তু দাঁড়িয়েই রয়ে গেল, স্ট্যাচুর মত , নড়তে ভুলে গেল, কথা বলা তো অনেক ক্ষণ আগেই ভুলেছে | যারা কানুকাকে প্র্যাক্টিসে উজ্জীবিত ভাবে খেলতে দেখেছে তারাও যারপরনাই অবাক , হল কি ছেলেটার | বিরতির এখনও ৭ মিনিট বাকি , এই সাত মিনিট কিভাবে কাটল আমরাই জানি , ওরা ৩ বার আক্রমণ করল এর মধ্যে , ২ বার কানুকা স্ট্যাচু হয়ে রইল, আমাদের গোলকীপার মিঠুন এগিয়ে এসে কোনোক্রমে পতন রোধ করল , পুলক দা অনেক চিৎকার করার পর কানুকা একবার ঘুরে তাকালো বেঞ্চ এর দিকে, তার পর সে নড়তে শুরু করলো বটে তবে ওই পর্যন্ত | তৃতীয় বার সে ব্যাকপাস দিতে গিয়ে সেম সাইড গোল করে ফেলেছিলো আরেকটু হলে , বল এ পোস্টে লেগে বেরিয়ে গেল, আমরা আমাদের হৃৎপিণ্ড হাতে নিয়ে বসে মাঠের বাইরে | রেফারি বিরতির বাঁশি বাজাতে আমরা প্রাণ ফিরে পেলাম |


বিরতির সময় সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম কানুকা উপর, নানা প্রশ্ন, বকুনি, উপদেশের যেন বর্ষা হতে লাগল, ছেলে-বুড়ো সবাই, এমন কি গ্রামের একশো দশ বছরের বুড়ি মোক্ষদামাসী ও | পুলক স্যার আর তারক ব্রহ্ম বাবু এসে সবাই কে সরালেন , যাওয়ার ইচ্ছে কারও ছিল বলে মনে হল না কিন্তু তারক বাবুর কথা অগ্রাহ্য করবে কে ? কানুকা চোখে মুখে জল দিয়ে ওদের সাথে বেশ খানিক ক্ষণ বসে থাকলেন, কি কথা হল জানিনা, কিন্তু কানুকাকে এখন অনেকটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে, যদিও সে এক্কেবারে চুপ, কোনো কথা নেই মুখে | 

এদিকে খেলা শুরুর সময় হয়ে আসছে, কানুকা একটু লেবুর শরবত খেয়ে মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত তখন ছুটতে ছুটতে সেখানে এলেন আমাদের গ্রামের পুরোহিত চক্কোত্তি মশাই | চক্কোত্তি মশাই বংশ পরম্পরায় আমাদের বুড়ো শিব মন্দিরের পুরোহিত | তার হাতে বুড়ো শিব মন্দিরের চন্নামিত্তি | মোক্ষদা বাসী আনন্দে চিৎকার করে উঠলো ,

- " ওই তো ওই তো ! এসে গেছে ! এবার কানুকে আর কেউ আটকাতে পারবেনা ! জয় বাবা ভোলানাথ !" এই বলে একটা পেল্লাই পেন্নাম ঠুকলেন |

বুড়ো শিব মন্দিরের চন্নামিত্তি খেয়ে কানুকা মাঠে নামল সবার শেষে|

খেলা শুরু হল শান্ত ভাবে, জীবনরাম উঠে যাওয়ার পর কুমোর পাড়া সার্বজনীন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলছে , আর আমাদের দল ঠিক উল্টো,সবাই ভয়ে কুঁকড়ে আছে গোল না খেয়ে যায়, মিডফিল্ডার রা আক্রমণে উঠতেই ভয় পাচ্ছে , এর মধ্যে আমাদের একটা আক্রমণ হল, কিন্তু মিস পাস হয়ে যাওয়াতে বল পড়লো ওদের সেই ভজা মিত্তিরের পায়ে, ভজা বল নিয়ে প্রতি আক্রমণে এগিয়ে চলল দ্রুত গতিতে এঁকে বেঁকে , কেউ নেই তাকে তারা করার রামজীবনের মত , সেন্টার লাইন পেরিয়ে সে ঢুকে পড়েছে আমাদের হাফে , আমাদের রাইট ব্যাক কেষ্ট শুধু স্পীডেই কেটে গেল, বিরতির পর কানুকার নড়াচড়া টা সাবলীল লাগছিল, এখন সে ই একমাত্র ভজার সামনে | আমরা ইষ্টনাম জপ করছি আবার , এমন সময় ভজার সামনে এসে কানুকা চিৎকার করে উঠল, ঠিক যেন রঘু ডাকাত , চোখ লাল, জবা ফুলের মত , ভজা কেমন ভড়কে গেল , সেই ফাঁকে কানুকা বল উড়িয়ে দিলো ওদের হাফে | এ যাত্রা রক্ষা পেল আমড়াতলা | 

মোক্ষদা মাসী চিৎকার করে উঠলো আবার ,

-" সব বুড়ো শিবের আশীর্বাদ ! কি চক্কোত্তি বলেছিলাম না চন্নামিত্তি আনতে শুরুতেই ?"

চন্নামিত্তির জোরেই হোক বা তারক বাবুর ভোকাল টনিকের জোরেই হোক কানুকা তখন স্বমেজাজে |


কিন্তু কানুকার এ ফিকির বেশিক্ষণ চলার ছিলনা , চলল ও না, পরেরবার ওদের খেলোয়াড় রা ভড়কালোনা | কিন্তু তাতে ফলে হল হীতে বিপরীত | কানুকার সেই শান্ত , হাবলা মার্কা ভাব এখন উধাও , এখন তার চোখে মুখে আগুনের ভাঁটা, যেন শ্মশান ঘাটের সেই কাপালিক, নরবলি দিতেও তার হাত কাঁপবেনা , কানুকা সোজা পা চালালো প্রতিপক্ষের পা লক্ষ্য করে , নিজেকে বাঁচাতে দু পা পিছিয়ে গেল ওদের খেলোয়াড় | ধাঁই করে বল উড়িয়ে দিলো কানুকা সেই সুযোগে |


এইসব অত্যাশ্চর্য ঘটনা আমারদের খেলোয়াড় দের মনোবল বাড়িয়ে দিচ্ছিল ক্রমশ , কানুকা তখন পুরো খুনে মেজাজে , মাঝে মাঝে উঠে যাচ্ছে বিপক্ষের হাফেও , ওরাও কানুকাকে সমঝে খেলছে | খেলা শেষ হতে আর বেশিক্ষণ নেই | আমাদের গোলকিপার মিঠুন খুব ভালো পেনাল্টি বাঁচায় , তার উপর সে দারুন ট্যারা, বিপক্ষের ফরওয়ার্ড রা ধরতে পারেনা সে কোনদিকে তাকাচ্ছে , সেই করতে গিয়ে গোল মিস করে , তাই টাই-ব্রেকারে গেলে আমাদেরই জেতার সম্ভবনা বেশি , আমরা গোল করার আশা ছেড়ে ভাবছি শেষ কয়েক মুহূর্তে গোল না খেলেই হল | আমাদের দলই অধিকাংশ সময় আক্রমণে থাকছিল হঠাৎ করে একটা প্রতি আক্রমণে উঠে এল ওদের দুজন খেলোয়াড় , ভজা ও কার্তিক , সামনে কানুকা একা | একজন কে কানুকা সামলে নিত হয়তো, কিন্তু দুজনকে কিভাবে সামলাবে সেই আমরা ভাবছি , আমার হাতে তখন মা শীতলার পুজোর ফুলের মাদুলি | 


এমন সময় ঘটল সেই কান্ড , যা না ঘটলে আমি আজ হয়তো আপনাদের গল্পটা বলতে বসতাম না | হারু গোয়ালার মোষটা এমনিতে ভীষণ শান্ত , কিন্তু কোলা ব্যাঙ দেখলেই ভীষণ ক্ষেপে যায় , আজ ও মাঠের পেছনের জলার ধরে সে বাঁধা ছিল, নির্ঘাত কোনো কোলা ব্যাঙ তাকে দর্শন দিয়েছে , সেও গেল ক্ষেপে | দেখা গেল মিঠুনের পাশ দিয়ে মাঠে ঢুকছে সেই মোষ , তীব্র গতিতে , ভজা আর কার্তিক তাকে দেখতে পেয়েছে, কানুকার পেছনে ঘটছে তাই সে দেখতে পায়নি, দেখতে পেলে কি করতো জানিনা | মিঠুন গোলপোস্ট ছেড়ে পালতে পালতে পেছন থেকে হাঁক মারল ,

-"কানু পালা !"

 কানুকার সেদিকে নজর নেই ,সে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কার্তিকের পায়ের দিকে তাকিয়ে | কার্তিক আর ভজা ততক্ষনে বল ছেড়ে যেদিকে পেরেছে দৌড় লাগিয়েছে, কানুকার লক্ষ্য বল , সে বল নিয়ে দৌড় শুরু করেছে , আর তার পেছন পেছন ছুটছে মোষ | মাঠে তখন হুলুস্থুল কান্ড , সব খেলোয়াড় এদিক সেদিক দৌড়োচ্ছে প্রাণ ভয়ে , কানুকার হুশ নেই, সে বাধা না পেয়ে বল নিয়ে কুমোরপাড়ার গোল এর দিকে ছুটছে, ঠিক তার পেছনেই মোষটা , বক্সের কাছে এসে সে যে শট মারতে গিয়েছে , মোষটাও তাকে দিয়েছে গুঁতিয়ে , বল শুদ্ধ কানুকা উড়ে গেছে গোল এর দিকে , সোজা জালে জড়িয়ে গেছে দুজনে , মোষ ও দাঁড়ায়নি , সেও দৌড়ে বেরিয়ে গেছে মাঠের বাইরে , রেফারি ততক্ষনে বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছে, গোল এর , আর ম্যাচ শেষের ও | মাঠ ভর্তি দর্শক চিৎকার করে উঠেছে গোওওওওওওওল ! কানুকা বল নিয়ে জালের ভেতরে তখন ও | সম্বিৎ ফিরে কুমোরপাড়ার খেলোয়াড় রা প্রতিবাদ করতে গেলে রেফারি অটুট রইলেন নিজের সিদ্ধান্তে | রাগে গজগজ করতে করতে কুমোরপাড়ার ছেলেগুলো মাঠের বাইরে গেল | ওদিকে পিলপিল করে লোক ঢুকছে মাঠে, তাদের লক্ষ্য কানুকা | কাঁধে তুলে নিয়েছে তাকে | কানুকা কিছুক্ষণ কোমরের ব্যাথাতে একটু কুঁকড়ে ছিল , সেও উঠে দাঁড়িয়েছে এবার, ততক্ষণে বুকের ছাতি তার ডবল হয়ে গেছে গর্বে | শোভাযাত্রার পুরোভাগে শিল্ড হাতে ঘরে করে গ্রামে ফিরলো সে আজ | সাথে তার পরিচিত হুঙ্কার | 


এরপর থেকে কানুকার খেলা নিয়ে গর্ব আর ধরত না , কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সে প্র্যাক্টিস আসা বন্ধ করে দিয়েছিল | জিজ্ঞেস করলে শুধু মুচকি হেসে পাশ কাটিয়ে যেত| আর কানাঘুসো শোনা যায় হারু গোয়ালার বাড়িতে দুধ নিতেও এরপর কানুকা কোনোদিন যেতনা | বোধহয় মোষের গুঁতোর ধাক্কাটা আর সামলে উঠতে পারেনি আমড়াতলার হিরো কানুকা |


© অরিন্দম রায়

No comments:

Post a Comment