Wednesday, October 3, 2018

মাতৃপক্ষ



মাটির প্রতিমার মতো দাঁড়িয়েছিল গৌরী ! সে পাথর হয়ে গিয়েছিলো ঘটনার আকস্মিকতায় | হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল কতক্ষন সে নিজেও জানেনা |
সে দাঁড়িয়ে আর সামনে পড়ে অজয় |  কিন্তু রাতটা শুরু হয়েছিল অন্যদিনের মতো একইভাবে |

কয়েক ঘন্টা আগের কথা :
বালিশে মুখ গুঁজে শুয়েছিল গৌরী | রাতে আর ঘুম আসতে চায়না | একা শুয়ে সে আনমনা হয়ে জেগে রয় | অজয় এখন ও ফেরেনি, রোজকার মতো আজ ও গিলছে হয়তো | আজ আবার তাদের ফিস্ট | ১০ ফুট বাই ১০ ফুটার টালির ঘরে একা রাত কাটানো এখন গৌরীর গা সওয়া হয়ে গেছে | চোখের জলের দাগ ও শুকিয়ে গিয়েছে, বোধহয় চোখের ও জলও | কাটা ঘা গুলো দগদগে , কিন্তু ব্যাথা আর হয়না | কিন্তু মনের দাগগুলো শুকোতে চায়না | সে আর তার সাথী ঘরের গুটিকয় আসবাব , একটা চৌকি, ১ টা মোড়া, খাটের পাশের দেওয়ালে লাগানো একটা কাঠের পাটাতনের উপর লোহার ট্রাঙ্ক, আর তার উপরে একটা মা দুর্গার ফটো দেওয়ালে টাঙানো | ফটোটা গৌরীরই আনা | সাথে কিছু রান্নার সামগ্রী ও জলের কুঁজো | এরাই তার সঙ্গী |
অনেক আশা নিয়ে বরের ঘরে এসেছিল, কিন্তু আজ সব আশা শেষ | কিন্তু জীবন এরকম ছিলনা|

দুই বড় ভাইয়ের পর তার জন্ম, টুকটুকে গায়ের রং দেখে বাবা নাম দিয়েছিলো গৌরী | দাদাদের আদরে বড় হয়েছিল সে | বাবা-দাদারা গরিব হলেও গ্রামে খাবার জুটতে কোনো অসুবিধে হয়নি কোনোদিন | উঠোন ঘেরা দোতলা মাটির বাড়িতে দিনগুলি সুখে কাটত |
পালকাকিমা অজয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসে, তার কোন এক দুঃসম্পর্কের দাদার ছেলে, কোলকাতাতে চাকরি করে | বাবা রাজি ছিলনা , বলেছিলো সবে তো একুশ , কিন্তু গ্রামের সবাই বললো ভালো সম্বন্ধ ছেড়োনা | বিয়েটাও হয়ে গেলো, অজয়দের গ্রামের বাড়ি তাদের থেকে ছোট হলেও মন্দ ছিলনা , কিন্তু অজয়কে শহরের বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলে বিশেষ বলতনা | শহরে এসে বস্তির মধ্যে এই ঘরটাতে এসে প্রথমে গৌরীর মাথায় বজ্রপাত হয় | তাও সে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, হাজার হোক এটাই তার সংসার | কিন্তু অবিরাম মদ্যপ বরের হাতে লঞ্ছিত হয়ে তার মন ক্রমশ শুকিয়ে যেতে থাকে| অজয় অধিকাংশদিন রাতে মাতাল হয়ে ফেরে, কোনোদিন ফেরেনা , সে জানে সেইদিন গুলোতে সে কোন পাড়াতে যায় | আর যেদিন আসে সেদিন তারপর চলে অকথ্য অত্যাচার | ধর্ষিত হতে থাকে তার শরীর ও মন |
তার ভাবনায় ছেদ পড়ে , দরজাতে করা নাড়ার শব্দে, অজয়ের গলা
- দরজা খোল ।
কিন্তু শুধু অজয়ের নয়, আরো একটা কণ্ঠ সে শুনতে পায় | সে খুলতে যাবে ভাবছে এমন সময় অজয় চিৎকার করে ওঠে |
সে দরজা খোলে আর দরজা দিয়ে ঢোকে অন্য এক মিনসে | অজয় বাইরেই দাঁড়িয়ে বলে
- আজ তুই এই বাবুকে খুশি কর |
এই বলে অজয় দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করতে গেলে গৌরী এক ধাক্কাতে লোকটাকে ঠেলে ফেলে  দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে আসে |
ছুটে পালতে চায় , এতদিন এতো অপমান সহ্য করেছে মুখবুজে কিন্তু আজকে বড় তাকে বেচে দিতে চায়? অজয় তার পেছনে ছোটে |
বেশিদূর পালতে পারেনা , অজয় তার চুলের মুঠি ধরে ঘরে আনে, অন্য লোকটা ধাক্কা খেয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়েছে |
অজয়ের রাগ তখন লাগাম ছাড়িয়েছে ,
- তুই বাবুকে মারলি, তোর এতো সাহস|
কান্নাও বেরোতে চায়না গৌরীর মুখ দিয়ে , অজয় মেরেই চলে অবিরত | সে অজয়কে ঠেলে সারানোর চেষ্টা করে, হঠাৎ ধাক্কাতে টাল সামলাতে না পেরে অজয় গিয়ে ধাক্কা মারে পেছনের পাটাতনটাতে , সে বসে পড়ে সেখানেই আর তার মাথার উপর পড়ে সেই লোহার ট্রাঙ্ক |

তখনও পাথর হয়েই ছিল গৌরী আর সামনে পড়ে রয়েছে ট্রাঙ্ক, ও  অজয়ের রক্তাক্ত দেহ, মাথা থেকে অবিরাম রক্ত ঝরেছে , আর তার মাথার উপর মা দুর্গার অসুরদলনি মূর্তির ফটোটা | সম্বিৎ ফিরলো যখন পাশের বাড়ি থেকে ক্ষীণ শাঁখের আওয়াজ ভেসে এল আর তারপর অষ্পষ্ট কিন্তু অমোঘ সেই মন্ত্রোচ্চারণ যা সে ছোটবেলাতে মায়ের কোলে বসে শুনতো মহালয়ার ভোরে | গৌরীর মনে পড়ল আজ মহালয়া | মাতৃপক্ষের সূচনা | সে ঠিক করে ফেলেছে তার পরের পদক্ষেপ , ঘরে ফিরবে গৌরী , এবার পুজোতে ফিরবে সে তার বাবার ঘরে | আর দেরি নয়, সে দ্রুত বেড়িয়ে পড়ল ঘর থেকে , বাইরে পুব আকাশ একটু ফর্সা হতে শুরু হয়েছে | আর রেডিওতে ভেসেআসছে গান -
"বাজলো তোমার আলোর বেনু "
আলোর দিকে এগিয়ে চললো গৌরী |

No comments:

Post a Comment