Thursday, October 25, 2018

মুড়ি,তেলেভাজা ও অদ্ভুতুড়ে গল্প



বৃষ্টি নামল ঝম ঝম করে | আকাশ পুরো অন্ধকার করে |
আগস্ট মাসের সন্ধ্যে | তার উপর শুক্রবার |
সপ্তাহান্তে ভর সন্ধ্যের এই বৃষ্টি এমনিতেই বেশ একটা আমেজ তৈরি করে , তার সাথে যদি বাল্য বন্ধু বহুদিন পর বাড়িতে উপস্থিত হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা | তাই আজ সন্ধ্যের আড্ডাটা  বেশি জমে উঠল |
রূপম অফিসের কাজে বেঙ্গালুরু এসেছিলো,আসার আগেই আমাকে ফোন করেছিল , দীর্ঘ ৪-৫ বছর আমাদের মুখোমুখি সাক্ষাৎ নেই, যা কথা বার্তা ওই সোশ্যাল মিডিয়াতেই | আমি সাফ বলে দি যে কাজ কর্ম সেরে সেদিনই ফেরার কোনো সম্ভবনা নেই, শুক্রবারের সন্ধ্যেটা আমার গরীবগৃহে কাটিয়েই যেতে হবে |
সে আপত্তি করেনি |শুক্রবার কাজ শেষ করে রাত্রিটা আমাদের বাড়িতে কাটিয়ে শনিবার  সকালে ফেরার টিকিট করে রেখেছে |

বৃষ্টিটা নামার আগেই আমরা বাড়ি ফিরেছি, ফেরার পথে রূপম কেও ওর অফিসএর সামনে থেকে তুলে না আনলে আজ ওর কপালে দু:খ ছিল, এই বাদলাতে ক্যাব পাওয়া যে সোজা কথা নেই সে কথা কারো অজানা নয় |
দেবারতি ও আজ অফিস থেকে ফিরেছে আগেই, মেঘ দেখে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েছিল | আমরা এসে একটু মুখ হাত ধুতে না ধুতেই দেখি চা সাথে গরম গরম ফুলুরি আর তেল চপচপে মুড়ির বাটি |দেখেই তো রূপম চোখ চকচকে , আমার ও | বললাম -এ হল বর্ষার সন্ধ্যের আদর্শ জল খাবার , এর সাথে ভূতের গল্প হলে জমে যেত |
রূপম হাসল, বলল ভূতের কিনা জানিনা তবে আমার স্টকে এক খান গল্প আছে যেটা আজকে ভালো মানাবে, শুনবি?
আমি নড়েচড়ে বসলাম, দেবারতি ও |
এখানে বলে রাখি, আমি, দেবারতি আর রূপম একই কলেজ থেকে পাস করেছি আর তাই আগে থেকেই আমার বন্ধুদের অধিকাংশ জনকেই ভালো ভাবে চেনে দেবারতি |
রূপম আমার সাথে স্কুলেও পড়তো |
কলেজে পড়ার সময়ও দারুন গল্প বলিয়ে হিসেবে রূপমের বেশ প্রভাব ছিল | তাই রূপম গল্প শুরু করবে বলতেই দুজনেরই চোখ চক চক করে উঠল |
একটু অবাক ও হলাম বটে , ভূতের ব্যাপারে রূপম চিরকালই  ভীতু গোছের | তাই ভূতের গল্প ওর মুখে শোনা অনেকটা ভূতের মুখে রামনাম শোনার মতো |
এটাই ভাবছি তখন রূপম নিজেই বলে উঠলো - "ভাবছিস তো যে আমি আর ভূতের গল্প ?"
 আমি একটা সম্মতিসূচক হাসি হাসলাম |
রূপম একটু হাসল | গল্প শুরু হল আর আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে লাগলাম চেয়ে চুমুক দিতে দিতে|
---
"বছর পনেরো আগের কথা, আমি তখন দিল্লিতে |সেবার যখন সৌমেন্দুর বিয়েতে বহরমপুর গেছিলাম, সেবারে তোরা তো গেলিনা, সদ্য বিয়ের পর আর ছুটি পাবিনা বলে | যাই হোক আমি গেলাম | সেই ক্লাস টেন দিয়ে যে বহরমপুর ছেড়েছি আর যায়নি | সময়টা এপ্রিল, অফিস থেকে লাঞ্চ সেরে বেরিয়ে গেলাম ফ্লাইট ধরতে, তখন এত এয়ারলাইন্স ছিলনা , ফ্লাইটের অপসন ও কম | দুপুর দুটোর  ফ্লাইট, পৌঁছে ভাগিরথী  ধরবো এরকম পরিকল্পনা , কিন্তু বিধি বাম |
প্রথমে টেকনিক্যাল কারণে ফ্লাইটে দেরি হল , তারপর কলকাতা এয়ারপোর্টে রানওয়ে পেতে দেরি হওয়াতে চক্কর টক্কর মেরে যখন ফ্লাইটে নামল তখন সূয্যি অস্ত গেছে | এয়ারপোর্ট এ পৌঁছে দেখি ঘড়িতে ছটা দশ |
ভাগীরথী এক্সপ্রেস হাতছাড়া, একটা উপায় কাল সকালের লালগোলা প্যাসেঞ্জের , কিন্তু ভাবলাম একটা গাড়ি করে নি, রাতেই পৌঁছে যাবো | কিন্তু তখন স্মার্টফোনেও নেই, ইন্টারনেট দিয়ে ক্যাব বুক করার সুবিধে ও নেই | স্মার্টফোন ভুলে যা, তখন ও কলকাতার বাইরে বেরোলে সিগন্যাল পাওয়া ও যেতনা, BSNL  ছিল একমাত্র ভরসা, ভাগ্যি আমার BSNL  ছিল | যাই হোক গল্পে আসি |আমার এক বন্ধু, কলকাতার ছেলে, বেশ করিৎকর্মা , আগে আমার সাথে ভোডাফোনে চাকরি করতো, একসাথে সিগারেট খেতাম , তারপর বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল | নাম বিশ্বজিৎ ,  তাকে  ফোন করলাম | সে যদি কোনো গাড়ি জোগাড় করতে পারে |
- "আরে তুই? হঠাৎ কি মনে করে?"
তাকে সব খুলে বললাম |
-" হুম , প্রয়োজনে মনে পড়েছে |"
-"একটা কিছু কর ভাই |"
-:ঠিক আছে দেখছি দাঁড়া, কলব্যাক করছি |"
ফোন টা কেটে একটা সিগেরেট ধরালাম , ৫ মিনিট বাদে একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল|

-" রূপম বাবু বলছেন ? আমাকে বিশ্বজিৎদা বললো আপনার একটা গাড়ি দরকার |"
-" পাওয়া যাবে? "
-" আপনার ভাগ্য ভালো, অন্য একটা ট্রিপ এই আধঘন্টা আগে ক্যানসেল হল , অ্যাম্বাসেডর গাড়ি চলবে ?"
-"চলবে কি মশাই , দৌড়োবে |"
এরপর টাকা পয়সা নিয়ে কথা সেরে আমি গাড়ির নম্বরটা লিখে নিলাম , আর বললো ড্রাইভার ফোন করবে | এক ঘন্টার মধ্যে এয়ারপোর্ট পৌঁছে যাবে গাড়ি |
আমি হাতে চাঁদ পেলাম , ভাবলাম সময় আছে , এখানে কিছু খেয়ে নি, তাহলে রাস্তাতে বিশেষ দাঁড়াতে হবেনা |
পেটপুজো সেরে একটা সিগেরেট ধরিয়েছি , ড্রাইভার এর পাত্তা নেই, হঠাৎ ফোন টা বেজে উঠল , ড্রাইভার |
-" স্যার , একটু এক্সিডেন্ট হয়েছিল , একটু দেরি হল| আপনি কোনখানে দাঁড়িয়ে ?"
আমার অবস্থানটা জানিয়ে লাগেজ গুলো নিয়ে রাস্তার সামনে দাঁড়ালাম |
গাড়ি চলে এল , উঠে তাড়াতাড়ি স্টার্ট করে দিলাম |

ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করলাম - " তোমার নাম কি?"
-"আজ্ঞে রতন "|
একটু খেজুরে আলাপের চেষ্টা করলাম, রতন কে বেশি আগ্রহী মনে হল না, তাই আমি ও চুপ মেরে গেলাম |

ঘন্টা দেড়েক এগোতেই বিপত্তি , দেখি পশ্চিম আকাশ কালো করে আসছে , ঠান্ডা হাওয়া বইতে লেগেছে , দ্রুত সেটা ঝড়ে পরিণত হল - কালবৈশাখী |

 তারপর শুরু হল বৃষ্টি , ফাঁকা হাইওয়েতে তুমুল বৃষ্টি যে কি জিনিস আগে দেখিনি |
ড্রাইভার কে বললাম "এতো বৃষ্টিতে গাড়ি চালিওনা, একটু দাঁড়িয়ে যাও "
-"স্যার এইখানে প্রচুর গাছ দাঁড়ানো সেফ হবেনা, আরেকটু এগোলে একটা ধাবা আছে , ওখানে দাঁড়াবো বরং |"
আরো দশ মিনিট পর গাড়ি থামলো, বৃষ্টির বেগ আরো বেড়েছে, তবে ঝড়টা কমেছে , কিন্তু এখানে এসে শুনলাম বেশ খানিক্ষন দাঁড়াতে হবে, সামনে গাছ ভেঙে পড়েছে রাস্তার উপর, বৃষ্টি না কমলে সেটা সরানো যাবেনা | ওখানে বেশ খানিকখন কাটালাম, চার পাঁচ কাপ চা আর বেশ কয়েকটা গোল্ড ফ্লেক ধ্বংস করতে করতে বৃষ্টি থামলো , ধাবার মালিক বললো
-" রাস্তা ক্লিয়ার হলে এগোবেন, মাঝ রাস্তায় দাঁড়ানোর চেয়ে এখানেই থাকুন |"

আমি ও ভাবলাম সেটাই ভালো, রুটি আর ডিম তড়কা সহযোগে নৈশাহারটা মন্দ হলনা, রতন কেও খেতে বললাম, কিন্তু সে বললো সে খাবেনা, তার খিদে নেই, আমি আর কথা বাড়ালাম না | আবার গাড়ি স্টার্ট করলাম , রাত প্রায় ৯ টা , আরো প্রায় ৩ ঘন্টার রাস্তা, বদলা দিনে বেশি ও হতে পারে |

এগিয়ে গিয়ে দেখি গাছ সরানো হয়ে গেছে , কিন্তু জ্যাম ভালোই আছে, সবাই ই বেরোনোর চেষ্টা করছে, আরো এক ঘন্টা লেগে গেলো ওখান থেকে বেরোতে |
ভাবলাম সৌমেন্দু কে ফোন করে দি দেরি হচ্ছে বলে , কিন্তু কলকাতা ছাড়ার পর সিগন্যাল কোথাও ও ঠিকঠাক পারছিনা, জানিনা ঝড়ের জন্য অন্য কোনো বিপত্তি কিনা |
জানিনা কখন একটু চোখ লেগে এসেছিল | হঠাৎ চটকা ভাঙল একটা sms  এর শব্দে |
আর sms টা ঘুম চোখে দেখে আমার চোখ কপালে উঠল | আমি ৩ বার পড়লাম , আর এই বর্ষা ভেজা শীতল হাওয়াতেও প্রথমে ঘামতে লাগলাম, তারপর একটা শীতল স্রোত বয়ে যেতে লাগলো মেরুদন্ড দিয়ে | বুঝতে পারলাম আমি জ্ঞান হারাচ্ছি | "

এই পর্যন্ত বলে রূপম একটু থামলো |

এইখানে গল্পের মধ্যে ব্যাঘাত ঘটিয়ে আমি আর দেবারতি একসাথে জিজ্ঞেস করলাম , "তারপর ? কি ছিল sms  এ?"

রূপম আবার হাসল , শুরু করল তার গল্পের শেষাংশ |

কতক্ষন অজ্ঞান ছিলাম জানিনা, যখন জ্ঞান ফিরল আমি বহরমপুর বাস স্ট্যান্ডের বাইরে একটা বেঞ্চে শুয়ে আছি , সুটকেস পাশে রাখা | উঠে ভাবলাম আমি কি স্বপ্ন দেখেছি? দ্রুত মোবাইলটা বার করে sms  টা দেখলাম, দেখলাম কোনো ভুল নেই, সেই sms এখন ও ইনবক্সে |

" রূপমবাবু, আপনাকে আমি ক্রমাগত ফোন করার চেষ্টা করছি কিন্তু খালি নট রিচেবল  পাচ্ছি, তাই sms করলাম | দুঃখিত আপনাকে গাড়ি পাঠাতে না পাড়ার জন্য , গাড়িটা যখন আপনাকে পিক আপ করতে যাচ্ছিল তখন পথে দুর্ঘটনা ঘটে ও চালকের সেখানেই মৃত্যু হয় | আশা করি আপনি অন্য ব্যবস্থা করতে পেরেছেন |"
 গল্প শেষ হল , আমার আর দেবারতি দুজনের চোখে মুখে অবিশ্বাস , বললাম -
"গুল মারছিস !"
- "একবর্ণ ও নয় " রূপম বলল, তবে গল্প এখানে শেষ নয় |
"শেষ নয় ?" - আঁতকে উঠে বলল দেবারতি
"উঁহু পিকচার অভি বাকি হে মেরে দোস্ত |"
রূপম বলে চলল -
" একবার ভাবলাম  বিশ্বজিৎকে ফোন করি , কিন্তু আমাকে ভীতু বলে আরো কত আওয়াজ দেবে এটা মনে হওয়াতে মন বদলালাম। কিন্তু মাথাটা কাজ করছেন।|
 এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল, ট্রাভেল এজেন্ট এর ছেলেটার নম্বর। কাঁপা হাতে ফোন ধরলাম - "হ্যালো!!"
উল্টোদিক থেকে বিশ্বজিতের গলা ভেসে এল, "গাড়ি পেলি? আর তারপর বিকট হাসি, হতভাগা, আমাকে তো কাজ না থাকলে মনে পড়েনা, তাই এটুকু শাস্তি দিলাম। যায় হোক, দু হাজার টাকা ভাড়া আমি দিয়ে দিয়েছে, আমার account-এ জমা দিয়ে দিস।"

 একসাথে হো হো করে হেসে উঠলাম তিনজনেই |

No comments:

Post a Comment