শরতের এই সাদা মেঘ গুলোর মধ্যে অদ্ভুত একটা মাদকীয়তা আছে ,অকারণেই মন টাকে ঘুরিয়ে দেয় সময়ের উল্টোরথে | পুজো আসছে - বাংলার কোনো এক কোণে জলঙ্গী নদীর চর টাতে নিশ্চয় কাশের গুচ্ছ হওয়াতে মাথা দোলাচ্ছে | এমন একজন ও বাঙালী বোধহয় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যার মন সেই হওয়ার সাথে দুলে ওঠেনা | শরৎ এসে গেছে, বাড়ির ছাদে টবে রাখা শিউলি গাছ টার ডালে কুড়ি ধরেছে,সকালে কিছু ফুল নীচে পরে আছে, আমাদের বহরমপুরের বাড়ির ছাদেও টবে একটা শিউলি গাছ ছিল | আরেকটা বড় শিউলির গাছ ছিল মামাবাড়ির কাছে ঠাকুরবাড়ির বাগানে , যেখানে বিশাল উঠোনটা ছিল আমাদের খেলার জায়গা আর খেলার ফাঁকে ফুল কুড়োতাম গাছের নীচে | ছোট্টবেলার সেই দিন গুলো আজ ও মনে পড়ে |
সেপ্টেম্বর মাস থেকেই শুরু হয়ে যেত তোড়জোড় | নতুন জামা কাপড় কেনার ধুম লেগে যেত | স্কুল থেকে ফিরেই প্যান্ডেলের কাজ কতটা এগোল দেখতে ছুটতাম | বিশ্বকর্মা পুজোর পর থেকে ব্যাপারটা একেবারে অন্তিম লগ্নে পৌঁছোত |আর পুজো শুরু হয়ে যেত মহালায়াতে|
মহালয়ার আগের রাতেই মামা বাড়ি চলে যেতাম | মামাবাড়িতে যৌথ পরিবার প্রচুর লোকজন, তাই মজা ই আলাদা | সে রাতে দিদার ঘরে মাটিতে ঢালাও বিছানা তে সব ভাইবোনেরা একসাথে আড্ডা মেরে শুয়ে পরতাম, তখন ও "কাজিন" ধারনাটা সেভাবে জনপ্রিয় হয়নি,সবাই ভাইবোন ছিল| সেই রাত টাতে ঘুম ভালো হতনা, খালি উত্তেজনা কখন ভোর হবে, ভোরের দিকে চোখ লেগে এলে আমাদের তুলে দেওয়া হত, দেখতাম রেডিও চালু হয়ে গেছে , ঘুম ভাঙত বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহেন্দ্রকন্ঠে | কাঁটা দিয়ে উঠত শরীরে ও মনে | সেই মুহূর্ত টার মধ্যে জাদু ছিল, সেই ভোর, সেই পুজো উন্মাদনা , সেই কন্ঠ সবে মিলে যে মূর্ছনার সৃষ্টি হত সেটা সম্ভব মহালয়ার ভোরের ওই মহেন্দ্রক্ষনেই |আর তাতেই ঘোষিত হত “মা আসছেন ”| বাজি পোড়ানোর চল ছিল মহালয়ার ভোরে আমাদের ওখানে, ছোট্ট বয়সে সেটাও ছিল এক আকর্ষণের বস্তু |
দূরদর্শনের পর্দাতে মহিষাসুরমর্দিনী শুরু হত সকাল ৫ টাতে বোধহয় |সেটাও ছাড়তাম না | তবে যেবার পাড়ার ক্লাবের প্রভাত ফেরি থাকত সেবার আর পুরো টা দেখা হয়ে উঠত না | সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে শরতের শিউলির গন্ধ মাখা ভোরের সেই প্রভাত ফেরির আগমনী গান আজ ও মনে গেঁথে আছে| তারপর ক্লাব এ ফিরে হালকা পেট পুজো - কচুরি আর আলুর খোসা সুদ্ধ তরকারী |
গঙ্গা(আদতে ভাগীরথী কিন্তু আমরা গঙ্গা বলেই ডেকে এসেছি) মামার বাড়ির কাছেই, যেবার প্রভাতফেরী হতনা সেবার যেতাম গঙ্গার ধারে,মহালয়ার সকালে, পিতৃপক্ষের অবসানে মাতৃপক্ষের আগমনে গঙ্গার ঘাটে তখন চলছে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ | ফিরতে ফিরতে বেলা বয়ে যেত, কিন্তু উৎসাহে ভাটা নেই, বরং চলত দিন গোনা , দ্বিগুন উৎসাহে|
পঞ্চমীর দিন থেকেই পুজো পুজো হিড়িক চূড়ান্তে পৌছে যেত ,অপেক্ষা শুরু হত কখন প্রতিমা আসবে তার | তখন আজকালকার মত তৃতীয়া থেকে প্রতিমার উদ্বোধনের প্রথা চালু হয়নি , অধিকাংশ মন্ডপে প্রতিমা আসত পঞ্চমী তেই | সেদিনই স্কুল হয়ে ছুটি পড়ত পুজোর, তাই আনন্দটা একটু বেশিই | রাতে আসত সাধারণত আমাদের ক্লাব এর প্রতিমা | আমরা রাত ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম, এই বুঝি এল... কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখতাম যে তখনও আসেনি.. এই ভাবে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়া |
তারপর ভোর হতেই এক লাফে বিছানা ছেড়ে সোজা মন্ডপে..আজ যে মহাষষ্ঠী, স্কুলও আগের দিন হয়ে বন্ধ | আজ থেকে তাই পুজোর ছুটি| "মেঘের কলে রোদ উঠেছে" গানটার সার্থকতা তখন আমাদের মনে প্রাণে গুঞ্জরিত | নীল শরতের আকাশ তখন দুগ্গা পুজোর গন্ধে ম ম করছে | কিছুক্ষণ প্যান্ডেলে থেকে বাড়ি ফিরে স্নান করেই বায়না লাগাতাম নতুন জামা-কাপড় পড়ার | মা বলত বিকেলে পড়িস, শুনতে বয়েই গেছে | নিজেই একটা বের করে এনে পড়ে ফেলতাম | তারপর একটা বন্দুক আর ক্যাপ নিয়ে ছুটতাম প্যান্ডেলে | সেখানে আরো সব বন্ধুরা চলে এলে শুরু হত আমাদের খেলা | ধুনোর গন্ধ,ঢাকের শব্দ যত বাড়ত ততই বাড়ত আমাদের খেলা... এই ভাবে ষষ্ঠী-সপ্তমীর সকাল গুলো কেটে যেত | ভাইবোনরা মিলে আসে পাশের কয়েকটা ঠাকুরও দেখে ফেলতাম | বেশি দুরে যাওয়ার অনুমতি ছিলনা | সন্ধ্যে হলেই শুরু হত পুজো পরিক্রমা | গাড়িতে বেরোনোর চল ছিলনা তখন,পায়ে হাঁটা ই ভরসা, কখনো সখনো একটু-আধটু পথ সাইকেল-রিকশা| আর চলার ফাঁকে টুকিটাকি খাওয়া | কখনও মটন রোল, কখনও মাংসের ঘুগনি বা ফুচকা , হেঁটে বেশি হাঁপিয়ে পড়লে মাটির ভাঁড়ে কুলফি | কতরকমের খাবারের পসরা সাজিয়ে বসে আছে রাস্তার ধরে, কাঁচের সেল্ফ এ ডিমের লাল ডালনা, কোথাও বা রঙ্গীন বরফের গোলা | এর সাথে হরেক রঙের বেলুন ও অন্যান্য জিনিস ছোটদের আকর্ষণ করার জন্য | খানিক ঠাকুর দেখা, তারপর জিরিয়ে নেওয়ার ফাঁকে খাওয়া | তবে বিশ্রামের বেশি অবকাশ নেই, আজ একটা দিক পুরো দেখে নিতে হবে, আরেকটা দিক অষ্টমীর রাতে, যেগুলো দেখা হয়ে উঠবে না তার জন্য নবমী তো রইলো ই |লম্বা লাইন ধরে ঠাকুর দেখা | ঢোকার সময়ে বিরক্ত হওয়া .. তারপর আবার সব ভুলে পরের মন্ডপে আবার লাইন- এ দাড়ানো | সেই সব ভোলার নয় | তার সাথে নিজেদের মধ্যে তর্ক কোন প্যান্ডেল তা ভালো .. কোন ঠাকুর টা বেশি সুন্দর |
অষ্টমীর সকাল টা একটা বিশেষ দিন | সকালে উঠে স্নান করে পাঞ্জাবী পড়ে সোজা ছুটতাম প্যান্ডেলে | অঞ্জলির সময় হয়ে এলো |যখন খুব ছোট ছিলাম তখন কখনো সখনো খেয়ে ফেলতাম | তবু ও অঞ্জলি দেওয়া চাই -ই -চাই | ওই পরিবেশ টাই আলাদা | ধুনোর গন্ধ মাখা মন্ডপে সদ্য স্নাত এলোকেশী দের ভীড়, ছেলেরাও আজ পাঞ্জাবী , তার সাথে ঠাকুর মশাই-এর অমোঘ মন্ত্রোচ্চারণ, সবার মুখে সেই এক -ই মন্ত্র উচ্চারণ প্রতিধ্বনির মত ঠেকত | তার সাথে ঢাকের শব্দে মুখরিত হত গোটা মন্ডপ টা |
অষ্টমীর আরেকটা বড় আকর্ষণ ছিল দুপুরের ভোগ | সেই দিন দুপুরে ভোগের খিচুরী মন্ডপে খাওয়া হত পাড়ার সবাই মিলে | খিচুরী, লাবড়া,লালশাক, নানান ভাজা , চাটনি ইত্যাদি | সে এক দারুন অভিজ্ঞতা |তারপর দুপুরে জমিয়ে আড্ডা সেরে একটু বিশ্রাম .. রাতে যে অনেকক্ষণ জাগতে হবে |.. সন্ধি পুজো আছে না!!!!!
অষ্টমীর রাত যত ঘনাত ততই বাড়ত প্রতিক্ষা, সেই মুহূর্তটার যে সময় মা দূর্গা মহিষাসুর কে বধ করেছিলেন | ১০৮ তা প্রদীপ জ্বালিয়ে সাজানো হত মন্ডপ, তার সাথে ওই গভীর রাতে ধুনুচি নাচে মেতে উঠত পারার বড়রা |
এইভাবেই চলে আসত বিদায়ের নবমী নিশি ... মন খারাপ শুরু .. পোহাও না নবমী নিশি |সেই মন খারাপ আমরা খুঁজে পেতাম মায়ের প্রতিমার মধ্যেও| ভাবতাম ঠাকুর ও বোধহয় কাঁদছে, বাপের ঘর ছেড়ে কৈলাসে ফিরে যাওয়ার আগে তার আঁখি ও সজল | দশমীর ঢাকের আওয়াজ , সিন্দুর খেলা আর বিসর্জনের নাচের মধ্যেই থাকত আগামীর প্রতিশ্রুতি "আবার এসো মাগো "|
এখনও পুজো আসে , শরতের আগমন বার্তা বয়ে আসে সাদা মেঘের দল ও .... কিন্তু সেই দিন গুলো যেন হারিয়ে গেছে .. তবে একটা জিনিস আজ ও টের পায় | নবমী নিশির সেই মন খারাপ করা অনুভূতি ... আজ আর সেই গন্ধটা সেভাবে পায়না খুঁজে | হয়ত গন্ধটা ছিল আমাদের মধ্যেই.. সেটাকে আমরাই হারিয়েছি... সেটাকে প্রত্যেকবার পুজো এলে নতুন করে খুজতে বসি | পুরোটা পায়না… আসছে বছর আবার হবে র সুরে সুর মিলিয়ে ভাবি পরের বার আবার খুঁজব|
আবার পুজো আসছে এখানে শরতের আকাশ চোখে পড়ে .. কিন্তু মন্ডপ, বাজারে লোকের সেই উদ্দীপনা নেই, তবু মনের মাঝেই খুঁজব সেই গন্ধ টাকে|
daroon. Chaliye ja.
ReplyDelete