Tuesday, September 22, 2009

Durga Pujo- Fire Dekha

শরতের এই সাদা মেঘ গুলোর মধ্যে অদ্ভুত একটা মাদকীয়তা আছে ,অকারণেই মন টাকে ঘুরিয়ে দেয় সময়ের উল্টোরথে পুজো আসছে - বাংলার কোনো এক কোণে জলঙ্গী নদীর চর টাতে নিশ্চয় কাশের গুচ্ছ হওয়াতে মাথা দোলাচ্ছে এমন একজন ও বাঙালী বোধহয় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যার মন সেই হওয়ার সাথে দুলে ওঠেনা শরৎ এসে গেছেবাড়ির ছাদে টবে রাখা শিউলি গাছ টার ডালে কুড়ি ধরেছে,সকালে কিছু ফুল নীচে পরে আছেআমাদের বহরমপুরের বাড়ির ছাদেও টবে একটা শিউলি গাছ ছিল আরেকটা বড় শিউলির গাছ ছিল মামাবাড়ির কাছে ঠাকুরবাড়ির বাগানে যেখানে বিশাল উঠোনটা ছিল আমাদের খেলার জায়গা আর খেলার ফাঁকে ফুল কুড়োতাম গাছের নীচে ছোট্টবেলার  সেই দিন গুলো আজ ও মনে পড়ে |
সেপ্টেম্বর মাস থেকেই শুরু হয়ে যেত তোড়জোড় নতুন জামা কাপড়  কেনার ধুম লেগে  যেত স্কুল থেকে ফিরেই প্যান্ডেলের কাজ কতটা এগোল দেখতে ছুটতাম বিশ্বকর্মা পুজোর পর থেকে ব্যাপারটা একেবারে অন্তিম লগ্নে পৌঁছোত |আর পুজো শুরু হয়ে যেত মহালায়াতে|
মহালয়ার আগের রাতেই মামা  বাড়ি চলে যেতাম মামাবাড়িতে যৌথ পরিবার প্রচুর লোকজনতাই মজা ই আলাদা সে রাতে দিদার ঘরে মাটিতে ঢালাও বিছানা তে সব ভাইবোনেরা একসাথে আড্ডা মেরে শুয়ে পরতামতখন ও "কাজিন" ধারনাটা সেভাবে জনপ্রিয় হয়নি,সবাই ভাইবোন ছিল|  সেই রাত টাতে ঘুম ভালো হতনাখালি উত্তেজনা কখন ভোর হবেভোরের দিকে চোখ লেগে এলে আমাদের তুলে দেওয়া হতদেখতাম রেডিও চালু হয়ে গেছে ঘুম ভাঙত বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহেন্দ্রকন্ঠে কাঁটা দিয়ে উঠত শরীরে ও মনে |  সেই মুহূর্ত টার মধ্যে জাদু ছিলসেই ভোরসেই পুজো উন্মাদনা সেই কন্ঠ সবে মিলে যে মূর্ছনার সৃষ্টি হত সেটা সম্ভব মহালয়ার ভোরের ওই মহেন্দ্রক্ষনেই |আর তাতেই ঘোষিত হত মা আসছেন ”| বাজি পোড়ানোর চল ছিল মহালয়ার ভোরে আমাদের ওখানেছোট্ট বয়সে সেটাও ছিল এক আকর্ষণের বস্তু 
দূরদর্শনের  পর্দাতে মহিষাসুরমর্দিনী  শুরু হত সকাল ৫ টাতে বোধহয় |সেটাও ছাড়তাম না তবে যেবার পাড়ার ক্লাবের প্রভাত ফেরি  থাকত সেবার আর পুরো টা দেখা হয়ে উঠত না সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে শরতের  শিউলির গন্ধ  মাখা  ভোরের  সেই  প্রভাত  ফেরির আগমনী গান আজ ও  মনে গেঁথে  আছেতারপর ক্লাব এ  ফিরে হালকা পেট পুজো  - কচুরি আর আলুর খোসা সুদ্ধ তরকারী |
গঙ্গা(আদতে ভাগীরথী কিন্তু আমরা গঙ্গা বলেই ডেকে এসেছি) মামার বাড়ির কাছেইযেবার প্রভাতফেরী হতনা সেবার যেতাম  গঙ্গার  ধারে,মহালয়ার সকালে,  পিতৃপক্ষের অবসানে মাতৃপক্ষের আগমনে গঙ্গার ঘাটে তখন  চলছে  পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ ফিরতে ফিরতে বেলা বয়ে যেতকিন্তু উৎসাহে ভাটা নেইবরং চলত দিন গোনা দ্বিগুন উৎসাহে|
পঞ্চমীর দিন থেকেই পুজো  পুজো  হিড়িক  চূড়ান্তে পৌছে যেত ,অপেক্ষা শুরু হত কখন প্রতিমা আসবে তার তখন আজকালকার মত তৃতীয়া থেকে প্রতিমার উদ্বোধনের প্রথা চালু হয়নি অধিকাংশ মন্ডপে প্রতিমা আসত পঞ্চমী তেই |  সেদিনই  স্কুল হয়ে ছুটি পড়ত পুজোরতাই আনন্দটা একটু বেশিই রাতে আসত সাধারণত আমাদের ক্লাব এর প্রতিমা আমরা রাত ১১টা  পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম,  এই বুঝি এল... কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখতাম যে তখনও আসেনি.. এই ভাবে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়া |
তারপর ভোর হতেই এক লাফে বিছানা ছেড়ে সোজা মন্ডপে..আজ যে মহাষষ্ঠী,  স্কুলও আগের দিন হয়ে বন্ধ আজ থেকে তাই  পুজোর ছুটি| "মেঘের কলে রোদ উঠেছে" গানটার সার্থকতা তখন আমাদের মনে প্রাণে গুঞ্জরিত নীল শরতের আকাশ তখন দুগ্গা পুজোর গন্ধে ম ম  করছে কিছুক্ষণ প্যান্ডেলে থেকে বাড়ি ফিরে স্নান করেই বায়না লাগাতাম নতুন  জামা-কাপড় পড়ার মা বলত বিকেলে পড়িসশুনতে বয়েই গেছে নিজেই একটা বের করে এনে পড়ে ফেলতাম তারপর একটা বন্দুক আর ক্যাপ  নিয়ে ছুটতাম প্যান্ডেলে সেখানে আরো সব বন্ধুরা চলে এলে শুরু হত আমাদের খেলা ধুনোর গন্ধ,ঢাকের শব্দ  যত বাড়ত ততই বাড়ত আমাদের খেলা... এই ভাবে ষষ্ঠী-সপ্তমীর সকাল গুলো কেটে যেত ভাইবোনরা মিলে আসে পাশের কয়েকটা ঠাকুরও দেখে ফেলতাম বেশি দুরে যাওয়ার অনুমতি ছিলনা সন্ধ্যে হলেই শুরু হত পুজো পরিক্রমা গাড়িতে বেরোনোর চল ছিলনা তখন,পায়ে হাঁটা ই ভরসাকখনো সখনো একটু-আধটু পথ সাইকেল-রিকশা|  আর চলার ফাঁকে টুকিটাকি খাওয়া কখনও মটন রোলকখনও মাংসের ঘুগনি বা ফুচকা হেঁটে বেশি হাঁপিয়ে পড়লে মাটির ভাঁড়ে কুলফি  |  কতরকমের খাবারের পসরা সাজিয়ে বসে আছে রাস্তার ধরেকাঁচের সেল্ফ এ ডিমের লাল ডালনাকোথাও বা রঙ্গীন বরফের গোলা এর সাথে হরেক রঙের বেলুন ও অন্যান্য জিনিস ছোটদের আকর্ষণ করার জন্য খানিক ঠাকুর দেখাতারপর জিরিয়ে নেওয়ার ফাঁকে খাওয়া তবে বিশ্রামের বেশি অবকাশ নেইআজ একটা দিক পুরো দেখে নিতে হবে,  আরেকটা দিক অষ্টমীর রাতেযেগুলো দেখা হয়ে উঠবে না তার  জন্য নবমী তো রইলো ই |লম্বা লাইন ধরে ঠাকুর দেখা ঢোকার সময়ে বিরক্ত হওয়া .. তারপর আবার সব ভুলে পরের মন্ডপে আবার লাইন- এ দাড়ানো সেই সব ভোলার নয় তার সাথে নিজেদের মধ্যে তর্ক কোন প্যান্ডেল তা ভালো .. কোন  ঠাকুর টা বেশি সুন্দর |
অষ্টমীর সকাল টা একটা বিশেষ দিন সকালে উঠে  স্নান করে পাঞ্জাবী পড়ে  সোজা ছুটতাম প্যান্ডেলে অঞ্জলির সময় হয়ে এলো |যখন খুব ছোট   ছিলাম তখন কখনো সখনো  খেয়ে  ফেলতাম তবু ও  অঞ্জলি দেওয়া চাই -ই -চাই ওই পরিবেশ টাই  আলাদা ধুনোর গন্ধ মাখা মন্ডপে সদ্য স্নাত এলোকেশী দের ভীড়ছেলেরাও আজ পাঞ্জাবী তার সাথে ঠাকুর মশাই-এর অমোঘ মন্ত্রোচ্চারণসবার মুখে সেই এক -ই  মন্ত্র  উচ্চারণ প্রতিধ্বনির  মত ঠেকত |  তার সাথে ঢাকের শব্দে মুখরিত হত গোটা মন্ডপ টা |
অষ্টমীর আরেকটা বড় আকর্ষণ ছিল দুপুরের ভোগ সেই দিন দুপুরে ভোগের খিচুরী মন্ডপে খাওয়া হত পাড়ার সবাই মিলে খিচুরীলাবড়া,লালশাকনানান ভাজা চাটনি ইত্যাদি সে এক দারুন অভিজ্ঞতা |তারপর দুপুরে  জমিয়ে আড্ডা সেরে একটু বিশ্রাম .. রাতে যে অনেকক্ষণ জাগতে হবে |.. সন্ধি পুজো আছে না!!!!!
অষ্টমীর রাত যত ঘনাত ততই বাড়ত প্রতিক্ষাসেই মুহূর্তটার যে সময় মা দূর্গা মহিষাসুর কে বধ করেছিলেন ১০৮ তা প্রদীপ জ্বালিয়ে সাজানো হত মন্ডপতার সাথে ওই গভীর রাতে ধুনুচি নাচে মেতে উঠত পারার বড়রা |
এইভাবেই চলে আসত বিদায়ের নবমী নিশি ... মন খারাপ শুরু .. পোহাও না নবমী নিশি |সেই মন খারাপ আমরা খুঁজে পেতাম মায়ের প্রতিমার মধ্যেওভাবতাম ঠাকুর ও বোধহয়  কাঁদছেবাপের ঘর ছেড়ে কৈলাসে ফিরে যাওয়ার আগে তার আঁখি ও সজল দশমীর ঢাকের আওয়াজ সিন্দুর খেলা আর বিসর্জনের নাচের  মধ্যেই থাকত আগামীর প্রতিশ্রুতি  "আবার এসো মাগো "|
এখনও পুজো আসে শরতের আগমন বার্তা বয়ে আসে সাদা মেঘের দল ও .... কিন্তু সেই দিন গুলো যেন হারিয়ে গেছে .. তবে একটা জিনিস আজ ও টের পায় নবমী নিশির সেই মন খারাপ করা অনুভূতি ... আজ আর সেই গন্ধটা সেভাবে পায়না খুঁজে হয়ত গন্ধটা ছিল আমাদের মধ্যেই.. সেটাকে আমরাই হারিয়েছি... সেটাকে প্রত্যেকবার পুজো এলে নতুন করে  খুজতে বসি পুরোটা পায়না… আসছে বছর আবার হবে র  সুরে সুর মিলিয়ে ভাবি পরের বার আবার খুঁজব|
আবার পুজো আসছে এখানে শরতের আকাশ চোখে পড়ে .. কিন্তু মন্ডপবাজারে লোকের সেই উদ্দীপনা নেইতবু মনের মাঝেই খুঁজব সেই গন্ধ টাকে|

1 comment: